হামিদুর রহমান,তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি: রাজশাহীর তানোর উপজেলার গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা, ঢেঁকি ও ধান ভাঙ্গানোর মিল এখন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং সংরক্ষণের স্থান সংকটের কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্য। ফলে, কৃষকদের এখন জমি থেকেই ধান বিক্রি করে বাজার থেকে বস্তাবন্দী চাল কিনে খেতে হচ্ছে।
এক সময় তানোরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে ধানের গোলা দেখা যেত। বাড়ির আঙিনায় থাকত খৈলানে খড়ের পালা, ঢেঁকি, আর পাড়ায় থাকত ধান ভাঙ্গানোর কাঠের মিল। গোলায় সংরক্ষিত ধান থেকে প্রয়োজনে চাল বানিয়ে খাওয়া ও বিক্রি করতেন কৃষকেরা। এই ধানের গোলা কেবল একটি খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমই ছিল না, ছিল সচ্ছলতা ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। বদলে গেছে সময়, বদলে গেছে দৃশ্যপট
৯০-এর দশক পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যেতে থাকে গ্রামীণ চিত্র। বাঁশ ও কাদা মাটির তৈরি গোলাগুলো এখন শুধুই স্মৃতির অংশ। আধুনিক স্টোরেজ পদ্ধতি এবং জমি সংকটের কারণে কৃষকরা আর গোলা নির্মাণে আগ্রহী নন। এমনকি ঢেঁকি ও মিলের স্থানও দখল করে নিয়েছে বাজারে ক্রয়যোগ্য বস্তাবন্দী চাল।
তানোর সদর গ্রামের বাসিন্দা এমদাদুল রহমান বলেন,
“আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির আঙিনায় ছোট-বড় অনেকগুলো ধানের গোলা ছিল। উঠানে বিশাল খড়ের পালাও থাকত। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়েরা আলাদা সংসার গড়ায় আর সেই দৃশ্য নেই। এখন ধান কাটার পরপরই তা বিক্রি করে দেই। সিন্দুকা গ্রামের আদর্শ কৃষক এমাজউদ্দিন জানান,
আগে আমাদের বাড়ির আঙিনায় ধানের গোলা ছিল। ভাইদের আলাদা সংসার হওয়ায় গোলা ভেঙে ফেলতে হয়েছে। এখন আর ধান সংরক্ষণ করি না।
আমসো গ্রামের মামুন জানান,
আমাদের বাড়িতে এখনো একটি ধানের গোলা আছে, তবে সেটি আর ব্যবহৃত হয় না। আমাদের জমিগুলো সব বছর চুক্তিতে লীজ দেয়া, ফলে ধান সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। বাজার থেকেই চাল কিনে খাই।
গোল্লাপাড়া মহল্লার প্রবীণ গৃহস্থ ওহাব সরদার বলেন,
একসময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গোলা, ঢেঁকি আর ধান ভাঙ্গানো মিল থাকত। এখন আর সেগুলো দেখা যায় না। এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য।
সচেতন মহলের মতে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ী ও মজুদদাররা। কৃষকদের নিজস্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে জমি থেকেই ধান বিক্রি করছেন। ফলে বাজারে চালের দামের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়ানো-কমানোয় ভোক্তারা ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তানোর সহ রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে একসময় গোলাভরা ধান মানেই ছিল আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক সম্মান। বিয়ের সময় পাত্রের পরিবারের ধানের গোলা, খড়ের পুঞ্জ এবং উঠানের বিস্তৃতি দেখে কন্যাপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে।
তানোরের গ্রামীণ জনপদের মানুষের মুখেই শোনা যাচ্ছে,
মাঠভরা সোনালী ধান থাকলেও নেই গোলা, নেই গোলাভরা ধান বা খৈলান ভরা খড়।
Leave a Reply