হারুন-অর-রশিদ বাবু; রংপুর
ইন্টার পাশ করে ঔষধ কোম্পানিতে সেলস ম্যানের কাজ করতাম, তখন নিজের বন্ধি জীবন মনে হতো। এছাড়াও নিজের কিংবা পরিবারের জন্য কিছু কেনার ইচ্ছে হলে বেতন অথবা বাবার কাছে টাকা নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতো মো. সোহেল রানা (৩০)। সামান্য বেতনে চাকুরী, মাসের বেশীভাগ সময় হাতে টাকা পয়সা থাকতো না। তবে এখন আর বেতন কিংবা বাবার অপেক্ষায় থাকতে হয়না। বাড়ির পতিত জমিতে নিজের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান “Deusen Dream” জৈব কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করে, অনেকটাই সাবলম্বী হয়েছেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার স্বচাষ গ্রামের কৃষক মো. শাফিউল্লাহ ছেলে তরুণ উদ্যোক্তা মো. সোহেল রানা।
এই উপজেলায় সোহেল রানার মতো অসংখ্য তরুণরা এখন নিজ উদ্যোগে কেঁচো সার উৎপাদনের মাধ্যমে দারিদ্রতা ঘুচিয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে তারা কেঁচো সার উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিতে ভালো ভুমিকা রাখতে সক্ষম। এছাড়াও উপজেলায় বৃহৎ কর্মসংস্থান করা সম্ভব বলে দাবি এই উদ্যোগক্তার।
সোহেল রানা বলেন, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে নিজের বাড়ির পিছনের পতিত জমিতে ৩ কেজি কেঁচো, এক ট্রলি গোবর, ছয়টি ফলের ক্যারেট দিয়ে প্রথম যাত্রা শুরু করি। যাতে প্রথম খরচ হয় চার হাজার পাঁচশত টাকা। ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় জুন মাসে আরও ২০ কেজি কেঁচো কিনে উৎপাদন শুরু করি। কেঁচোর আচরণ, বংশ বিস্তার, পরিবেশ সবদিক খেয়াল করে ওই বছরের ১৭ আগষ্ট পুনরায় ১৫ কেজি কেঁচো কিনে মোট ৩৮ কেজি কেঁচো দিয়ে বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করি। তিনি আরও বলেন, Deusen Dream জৈব কেঁচো সার প্রতিষ্ঠানটি বানিজ্যিক উৎপাদনে সর্বমোট খরচ পড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা। একবছরে সার বিক্রি করেছি ১০ টন, যার মুল্য- এক লাখ বিশ হাজার টাকা। মজুদ আছে ৪ টন, মুল্য -৪০ হাজার টাকা। কেঁচো আছে ৫০০ কেজির বেশী। যার বাজার মুল্য ৫ লক্ষাধিক টাকা। ইতিপূর্বে কেঁচো বিক্রি করেছি ১৬ কেজি।
প্রতি কেজি সার উৎপাদনে খরচ ৩ টাকা বিক্রি ১০ টাকা। বর্তমানে আমার প্রজেক্টে কাজ করছি আমরা তিনজন। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে বৃহৎ কর্মসংস্থান গড়ে তোলা সম্ভব।সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার স্বচাষ গ্রামে বাড়ির পিছনে সুপারি বাগানে আচ্ছাদিত ছাঁয়া পরিত্যক্ত যায়গাতে কেঁচো সার উৎপাদন করা হচ্ছে। কর্মরত এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো: সায়মন হাসান তুহিন, বলেন আগে কলেজ থেকে এসে ফেসবুক নিয়ে পরে থাকতাম, ৭ মাস যাবৎ Deusen Dream- জৈব কেঁচো সার উৎপাদন প্রজেক্টে কাজ করছি। এখনে আমার কৃষি সমন্ধে শেখার পাশাপাশি আয়ও হচ্ছে। আমি দেশের কৃষি খাতকে সমৃদ্ধশালী করার স্বপ্ন দেখি।মো. শাফিউল্লাহ বলেন, আমার দুই ছেলে এক বছর হলো বাড়িতেই কেঁচো সার উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছে। আগে সংসারে টানাপোড়েন ছিল এখন তা অনেকাংশে কমেছে। ছোট ছেলে কলেজে পড়া নিয়ে এখন আর টেনশনে থাকতে হয়না।কেঁচো সার বিক্রির টাকায় ছেলের পড়ালেখা ভালোই হচ্ছে। সংসার খরচের টাকার একটি অংশ সার বিক্রি থেকে আসছে।উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার জোলেখা বেগম বলেন, পীরগাছা উপজেলায় মাটির স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য, পরিবেশসম্মত কৃষির চর্চায় কেঁচো সার উৎপাদন ও বিপণন এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখন গ্রামের নারীরাও কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) সমন্ধে জানে, প্রায়’ই যায়গায় কেঁচো উৎপাদন সমন্ধে কৃষকরা জানতে চায়। আমার পরামর্শে প্রায় ১০টি বাড়িতে নারীরা কেঁচো সার উৎপাদন করছেন।পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির নামে আমাদের দেশের কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন। এতে শুধু মানুষের খাবারই বিষযুক্ত হচ্ছে না। জমির উর্বরতা শক্তি ও জৈবিক উপাদানও কমে যাচ্ছে। কেঁচো সার ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি জমিনের উর্বরতাও বাড়ে। ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকেরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে কেঁচো সার উৎপাদনে উপজেলার অনেক উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। আমাদের উপজেলায় প্রায় ৯৫০ টি স্থানে জৈব কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনসহ আমাদের যা করনীয় আছে তা করা হবে।
Leave a Reply